রংপুর মেট্রোপলিটন হাজীর হাটে ট্রাক শ্রমিক খলিল কে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যার অভিযোগে বিচার চাননা পরিবার -প্রতিকী ছবি।
ট্রাক শ্রমিক খলিলের রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে স্থানীয়দের মনে নানা প্রশ্ন। হত্যা হলেও বিচারই চাননা নিহতের পরিবার! গত ১৭ মার্চ সোমবার সকাল ৭টার দিকে রংপুর সিটির ১১নং ওয়ার্ড বিন্যাটারী ঘাঘট নদীর পাড়ে ট্রাক শ্রমিক খলিল (৪৫) কে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যার অভিযোগে ফেসবুকে ভিডিও ভাইরাল।
রংপুর মহানগরীর ১১নং ওয়ার্ড বিন্যাটারীতে ঘাঘট নদী থেকে অবৈধ বালু সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে, এক শ্রমিককে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় বালু সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রকদের বিরুদ্ধে। অনেকের মতে পুর্ব শত্রুতার জের ধরে ট্রাক শ্রমিক খলিলকে পুর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। নিহত মো: খলিল (৪৫) পেশায় একজন ট্রাক শ্রমিক। মহানগরীর ১নং ওয়ার্ডের উত্তর কুটির পাড় গ্রামের আব্দুর রহমান মাষ্টারের ছেলে, তিন কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জনক।
খলিলের মৃত্যুর রহস্য জানার চেষ্টার অংশ হিসেবে, গত ১৮ মার্চ ২০২৫ইং একাধিক গণমাধ্যমে "রংপুর সিটি কর্পোরেশন ১১নং ওয়ার্ডের বিন্যাটারী ঘাঘট নদীতে শত্রুতার জের ধরে ট্রাক শ্রমিক খলিল নামে এক যুবককে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ" শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত সংবাদের সুত্র ধরে। প্রকাশিত সংবাদ ও সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী ও গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে কথা বলে জানাযায়, দীর্ঘদিন যাবৎ বে-আইনীভাবে বালু সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন ওই এলাকার, পুণ্য চন্দ্র রায় (৫৫) লেবু চন্দ্র রায় (৩৭) আব্দুল মতিন মিয়া (৩৭) ও লেবু মিয়া (৪২)। এদের খুটির জোর বলতে এলাকার প্রভাবশালী হাজীর হাট থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহবায়ক মিজানুর রহমান মিলন। সকলের গ্রামের বাড়ী ১১নং ওয়ার্ডে ঘটনাস্থল সংলগ্ন। খলিল হত্যা নাকি স্বাভাবিক মৃত্যু এবং বালু সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত ৫ আগষ্টের পরেই তিনি এই ব্যবসায় নেমেছেন। তিনি জমির মালিকদের টাকা দিয়ে তাদের জমি থেকে মাটি কিনে বিক্রি করছেন। তবে সরকারি কোন অনুমোদন নেই, অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তা আছে বলেও মনে করেন না তিনি। খলিলের মৃত্যু ও সাংবাদিককে হুমকির বিষয়ে জানতে চাইলে মিলন বলেন, অতি উৎসাহী কিছু সাংবাদিক আমার পিছনে পড়েছে। খলিল আমার পয়েন্ট থেকে বালু আনতে গিয়ে মারা গেছে কীভাবে মারা গেছে সেটা তার সাথের শ্রমিকরা বলতে পারবে। আপনি তাদের সাথে যোগাযোগ করেন। এছাড়াও তিনি নিহত খলিলের পরিবারকে ব্যক্তিগত সহযোগিতা করার কথা জানান, এবং সাংবাদিকদেরও এগিয়ে আসার আহবান করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি সাংবাদিকদের বলেন, খলিলকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা পরবর্তী খলিলের মরদেহ অটোযোগে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত্যু ঘোষণা করলে, ঘটনায় জরিতরা টাকার বিনিময়ে হত্যার ঘটনাকে হার্ট এ্যাটাক বলে মৃত্যু সনদ নেন। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে দ্রুত লাশ দাফনের জন্য নিহতের পরিবারকে চাপ দিতে থাকেন। এবং বিকাল তিনটার মধ্যেই লাশ দাফন কাজ সম্পাদন করেন।
রংপুর মেট্রোপলিটন হাজীরহাট থানার এসআই আব্দুস সালাম সবার আগে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। এবিষয়ে তিনি বলেন আমরা খলিলের মৃত্যুর খবর সাংবাদিকদের মাধ্যমে পাই। পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে শুনি খলিলকে রমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পরে মেডিকেলে গিয়ে জানতে পারি নিহতের লোকজন লাশ বাড়িতে নিয়ে গেছে। দুপুর আনুমানিক আড়াইটার দিকে নিহতের বাড়িতে যাই, সেখানে গিয়ে দেখি নিহতের পরিবার লাশ দাফনের প্রস্তুতি নিয়েছে।গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের সুত্রে জানাযায়,খলিল হত্যার বিষয়টি হাজীরহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মামুনুর রশিদকে সাংবাদিকসহ একাধিক ব্যক্তি মোবাইল ফোনে জানানোর পাঁচ ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে পারেনি তিনি।
দৈনিক গণকন্ঠের বিশেষ প্রতিনিধি আতিকুর রহমান আতিক বলেন, আমি নিজেই ট্রাক শ্রমিক খলিলের সন্দেহজনক মৃত্যুর খবরটি একাধিকবার রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আব্দুল মজিদ, হাজীর হাটা থানার ওসি মামুনুর রশীদ, কোতোয়ালি থানার ওসি আতাউর রহমান কে নিশ্চিত করেছি। রহস্যজনক কারণে বিষয়টি তারা দায়িত্ব সহকারে আমলে নেয়নি। প্রশাসনের নীরবতার সুযোগে বালু সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রক চক্রটি বাদী পরিবারকে হুমকির মুখে রেখে দ্রুত লাশ দাফন করতে বাধ্য করেন।
প্রকাশিত সংবাদ সুত্রে জানা গেছে, রংপুর ক্যান্টমেন্ট কর্মরত মেজর নাহিদ খলিলের মৃত্যুর বিষয় রিপোর্ট না করতে সাংবাদিককে হুমকি দেন। হুমকির বিষয়ে জানতে চাইলে মেজর নাহিদ বলেন, আমি রিপোর্ট না করতে হুমকি দেইনি! ঘটনার দিন রাত আটটার দিকে নিহতের ছেলে আমাকে ফোন করে বলেন যে, বাবা মারা গেছে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স নিয়ে লাশ দাফন করেছি। এখন আবার পুলিশ বলছে লাশ তুলতে হবে! পরে আমি হাজীর হাট থানার ওসিকে ফোন দিলে তিনি আমাকে জানান সাংবাদিক নাকি ওসি এবং কমিশনারকে চাপ দিচ্ছে। ওসি আমাকে বলে স্যার সাংবাদিকদের মনে হয় টাকা খাওয়ার ধান্ধা আছে! সাংবাদিকদেরতো এরকম ধান্ধা থাকেই। পরে আমি তাকে (সাংবাদিককে) ফোন করে বললাম আপনার যদি টাকা পয়সার কোন ধান্ধা থাকে তাহলে আপনি যে বালু তুলতেছে তার সাথে কথা বলেন। আপনি কোন ঝামেলা কইরেন না, যে মেইন হোথা তাকে আপনি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। আমি আর একটা কথা বলছি যে, আপনি লাশের টাকায় ব্যবসা কইরেন না। এছাড়া আমি তাকে রিপোর্ট না করতে কোন হুমকি দেইনি। এবিষয়ে হাজীর হাট থানার ওসি বলেন সাংবাদিকদের নিয়ে কোন মন্তব্য আমি করিনি।
মেজর নাহিদের দেয়া তথ্যমতে, দিনাজপুর দশমাইল হাইওয়ে থানায় কর্মরত পুলিশ কন্সটেবল সাইফুল ইসলাম নিহত খলিলের জ্যাঠাতো ভাইয়ের সাথে কথা হলে, তিনি জানান, ঘটনার দিন তিনি ঘুমে থাকতেই তার এলাকার রফিকুল ড্রাইভার তাকে ফোন দিয়ে বলেন, খলিল কাজে এসে স্টোক করেছে! বাড়িতে খবর দেয়ার জন্য পরে আমি খলিলের বড়ভাই জলিলকে বিষয়টি জানাই। মেডিকেল সার্টিফিকেট দিসে স্ট্রোক হয়ে মারা গেছে। আমরা তো ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম না, যেভাবেই মারা যাক এখন তো আর সে ফিরে আসবেনা! আমাদের আর কোন দাবী নাই। আমাদের কোন অভিযোগ নাই যা হবার তাই হয়েছে। আপনাদের কাছে অনুরোধ এগুলো নিয়ে আর লেখালেখি কইরেন না।
নিহত খলিলেল বড় ভাই আ: জলিলের নিকট তার ভাইয়ের মৃত্যুর বিষয় জানতে চাইলে তিনি প্রথমে বলেন, আমার ভাই হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে। আবার বলেন মাটি চাপা পরে আহত হয়ে মারা গেছে। ঘটনাস্থলে মাটি চাপা পড়ার মতো কোন অবস্থা নাই কিভাবে মাটি চাপা পড়লো? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভাই আল্লার মাল আল্লায় নিছে আমরা মুর্খ মানুষ এসব কিছু বুঝিনা। আমার ভাই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে ডাক্তারের সার্টিফিকেট আছে। আপনারা এসব বাদ দেন। এবিষয়ে রফিকুল ড্রাইভারের নিকট জানতে চাইলে তিনি আমাদের কন্ঠকে নিশ্চিত করে বলেন, স্ট্রোক নয় খলিল গাড়ি চাপায় মারা গেছে।
নিহত খলিলের ছেলে সোহেল এর নিকট তার পিতার মৃত্যুর সত্যি ঘটনা জানতে চাইলে, তিনি ক্ষেপে গিয়ে সাংবাদিককে বলেন সত্যিটা জানার কি লাগছে আমার বাপ মরছে আমরা যদি কিছু না করি তাহলে আপনাদের (সাংবাদিকদের) এতো ঝাপাঝাপি ক্যান? আমার বাপ স্ট্রোক করে মারা গেছে আমাদের কাছে সার্টিফিকেট আছে।
অসংখ্যবার সংবাদ প্রকাশ ও অভিযানেও ঘাঘট নদী থেকে অবৈধ বালু খনন বন্ধ হচ্ছে না। বালু সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে ইতিপূর্বেও রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ১নং ওয়ার্ডে একটি হত্যাকান্ড ঘটেছিল। প্রশাসনের নাকের ডগায় ও লাশের উপর দিয়েই বালু দস্যুরা তাদের অবৈধ বালু খনন ও উত্তোলন ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।অভিযোগ আছে রংপুর মেট্টোপলিটন হাজীরহাট থানার অফিসার ইনচার্জ মামুনুর রশীদ ও সহকারী কমিশনার ভূমি ফরিদা বেগম, দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকার অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের সাথে গোপন আঁতাত করে চোখ কান বন্ধ করে রেখেছেন। এতে ১৪নং ওয়ার্ডে মনোহরপুরে মনু গংয়ের অবৈধ বালু উত্তোলন থেমে নেই। ঘাঘট নদীর পাশ ঘেষা রংপুরের ঐতিহাসিক দামোদরপুর বড় ময়দান থাকার পরও অবৈধ বালু উত্তোলন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এবিষয়ে রংপুর জেলা প্রশাসক বরাবর গত ৬ জানুয়ারি, ২০২৫খ্রি. অভিযোগ দিলেও এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি কতৃপক্ষ। সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, ঘাঘট নদীর ৮টি পয়েন্টে অবাধে চলছে বালু উত্তোলন।
উপরোক্ত বিষয়ে হাজীর হাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মামুনুর রশীদ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আমরা তদন্ত করছি। আশা করি তদন্তে সত্যিটা বেরিয়ে আসবে। তদন্ত সাপেক্ষে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তৃতীয় পক্ষের কথা শুনে পুলিশ সাংবাদিক কোন বিতর্কে না জড়ানোর অনুরোধও জানান তিনি। এছাড়াও তিনি খলিল হত্যা নাকি নিহত সেই বিষয়ে পুলিশকে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানান।